ঠিক আট মাস আগে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় স্থান পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন নন্দিনী রানী সরকার। কিন্তু সেই আনন্দের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তার বাবার দুশ্চিন্তা। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালানো মানুষটি কীভাবে মেয়েকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করাবেন? সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন অনেকেই। সেই মেধাবী নন্দিনী আবারও সংবাদ শিরোনাম হলেন। তবে তিনি হলেন হৃদয়বিদারক খবরের সংবাদ।
ঝিনাইদহের শৈলকুপায় দুর্গাপূজা উপলক্ষে মামাবাড়িতে বেড়াতে এসে মদপানে অসুস্থ হয়ে মারা যান নন্দিনী রানী সরকার (১৮)। তিনি মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। রবিবার (৫ অক্টোবর) ভোরে কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
নন্দিনীর বাড়ি মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার নবগ্রাম ইউনিয়নের গিলন্ড গ্রামে। দুই বোনের মধ্যে নন্দিনী বড়। ছোট বোন বিনা রানী সরকারও মেধাবী শিক্ষার্থী। চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯ জানুয়ারি ফলাফল ঘোষণায় দেখা যায়, মেধাতালিকায় নন্দিনী রানী সরকারের অবস্থান ১৩৩। তালিকা অনুযায়ী নন্দিনী ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন।
জানা গেছে, দুর্গাপূজা উপলক্ষে নন্দিনী ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার ভান্ডারীপাড়া গ্রামে নানার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। সেখানেই পূজায় মদ্যপানে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।
নন্দিনীর নানা সঞ্জয় কুমার সরকার জানান, দশমীর দিনে বান্ধবীদের সঙ্গে বিসর্জন উপলক্ষে ঘুরতে গিয়ে তারা মদপান করে বলে জানা যায়। পরে রাতে নন্দিনী অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে শৈলকুপা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। কিছুটা সুস্থবোধ করলে চিকিৎসক ছাড়পত্র দেন। তবে পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়লে আবারও তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে রেফার করা হয়, সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ভোররাতে মারা যান নন্দিনী।
নন্দিনীর বড় কাকা গণেশ চন্দ্র সরকার বলেন, চিকিৎসকরা জানিয়েছেন অতিরিক্ত মদপানের কারণে নন্দিনীর মৃত্যু হয়েছে। আমরা কুষ্টিয়া হাসপাতাল থেকে মরদেহ নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছি। ভাতিজি অনেক মেধাবী ছিল, তাকে হারিয়ে পরিবারে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
শৈলকুপা থানার ওসি মাসুম খান বলেন, ঘটনাটি আমরা শুনেছি। বিস্তারিত তথ্য এখনো পাইনি। এ বিষয়ে থানায় কোনো অভিযোগও জমা পড়েনি।
জানা গেছে, নন্দিনী ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তিনি স্থানীয় গিলন্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ-৫, কানিজ ফাতেমা গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায় জিপিএ-৪ দশমিক ৪৬, এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ এবং এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন। এরপর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় দারুণ সাফল্য পেয়েছিলেন।
মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় নন্দিনীর সাফল্যে বাবা অনিল চন্দ্র সরকার খুশি হয়েছিলেন, তবে জানিয়েছিলেন সংকটের কথাও। তিনি বলেছিলেন, ইজিবাইক চালিয়ে উপার্জনের টাকায় দুই মেয়ে, স্ত্রী ও বাবা-মাকে নিয়ে ছয় সদস্যের সংসার চালান। কয়েক বছর আগে অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি মারাত্মক আর্থিক সংকটে পড়েন। সেই সংকটই কাটিয়ে উঠতে পারেননি।
মেধাবী শিক্ষার্থী নন্দিনী রানী সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তার নির্দেশে তখন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খানম রিতা এবং ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি তৌহিদুর রহমান আউয়াল নন্দিনীদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। নন্দিনীকে তারা মেডিকেলে পড়াশোনার বই ও নগদ অর্থসহায়তা করেছিলেন।
ভবিষ্যতে চিকিৎসক হয়ে দরিদ্র রোগীদের সেবা করার স্বপ্ন ছিল নন্দিনীর। তার অকাল মৃত্যুতে থেমে গেল চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন। নন্দিনী বলেছিলেন, ‘স্কুল ও কলেজে স্যাররা আমাকে বিনা বেতনে পড়িয়েছেন। বই থেকে শুরু করে সব সহায়তা পেয়েছি। আমার বাবার তো সামর্থ্য নেই যে এত টাকা দিয়ে পড়াবে। আমি যেমন দরিদ্র, অনেক দরিদ্র মানুষ আছে, যারা বিনা চিকিৎসায় মারা যায়, আমি তাদের সাহায্য করতে চাই, সেবা করতে চাই।’