রাজধানীর শাহজাদপুরের বীর উত্তম রফিকুল ইসলাম এভিনিউয়ের মজুমদার ভিলার সৌদিয়া আবাসিক হোটেলে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও দুইজন। আহতদের দ্রুত উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হলেও এখনও তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা যায়নি।
সোমবার (৩ মার্চ) দুপুরে লাগা এই অগ্নিকাণ্ডে ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে চারজনের মৃত্যু হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ।
ছেলেকে বিদায় জানাতে এসে বাবার চিরবিদায়
নিহতদের মধ্যে একজনের পরিচয় পাওয়া গেছে— তিনি পিরোজপুর জেলার মিরন জমাদ্দার (৬০)। পরিবারের সদস্যরা জানায়, মিরনের ছেলে মুবিন জমাদ্দার সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য মঙ্গলবার (৪ মার্চ) সন্ধ্যার ফ্লাইট ধরবেন। বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলেকে বিদায় জানানোর। এ কারণে তিনি সকাল ৮টায় শাহজাদপুরের সৌদিয়া আবাসিক হোটেলে ওঠেন, যাতে বিমানবন্দরে যেতে সুবিধা হয়।
মিরন তার বোনের স্বামী হিরন তালুকদারের সঙ্গে সকালে পিরোজপুর থেকে ঢাকায় আসেন। হোটেলে উঠেই নাশতা করতে বাইরে যান, এরপর ফিরে বিশ্রাম নিতে যান। কিছুক্ষণ পরই ভবনটিতে আগুন লাগে। বের হওয়ার পথ না পেয়ে মিরন ফোন দেন তার ভগ্নিপতি হিরন তালুকদারকে।
‘আমি বাঁচার কোনও পথ পাচ্ছি না, চারদিকে ধোঁয়া, দম বন্ধ হয়ে আসছে…’ কান্না ভেজা কণ্ঠে বলার পরই ফোন কেটে যায়। পরে ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণে এনে চারতলার ৪০২ কক্ষ নম্বর থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে। কথাগুলো বলছিলেন— ভগ্নিপতি হিরন তালুকদার।
সোমবার দুপুর ১২টা ১৭ মিনিটের দিকে শাহজাদপুরের সৌদিয়া হোটেলে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে দুপুর ১টা ৪ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক কাজী নজমুজ্জামান বলেন, ‘আগুন লাগার ১০ মিনিটের মধ্যেই আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছাই। ভবনটি ছয়তলা বিশিষ্ট, নিচতলায় তিনটি দোকান, দ্বিতীয় তলায় বিউটি পার্লার, আর তৃতীয় থেকে ছয়তলা পর্যন্ত আবাসিক হোটেল। আগুন মূলত দ্বিতীয় তলায় লেগেছিল। ধোঁয়া বের হতে না পারায় উপরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে।’
ধোঁয়ার কারণে মৃত্যু
ফায়ার সার্ভিস জানায়, আগুন লাগার পর চারজন আতঙ্কিত হয়ে ছাদে যাওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু ছাদের দরজা তালাবদ্ধ থাকায় তারা আটকা পড়েন। ফলে ধোঁয়ার কারণে তিনজন সিঁড়িতে এবং একজন চারতলার বাথরুমে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান।
আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর ভবনটির চারতলার একটি বাথরুম থেকে এক ব্যক্তির মরদেহ পাওয়া যায় এবং ছয়তলার ছাদের গেটের সামনের সিঁড়ি থেকে তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া দুইজনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা কাজী নজমুজ্জামান জানান, আগুনের প্রকৃত কারণ এখনও জানা যায়নি। তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, আগুনের সূত্রপাত হয়েছে দ্বিতীয় তলার গোল্ডেন টিউলিপ বিউটি পার্লার থেকে। কেউ কেউ দাবি করেছেন, পার্লারের এসি বিস্ফোরণ থেকে আগুনের উৎপত্তি হয়।
ভবনটির নির্মাণ ত্রুটি ও নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে ফায়ার সার্ভিস জানায়, ভবনটি রাজউকের নিয়ম মেনে তৈরি হয়নি। কোনও ফায়ার সেফটি প্ল্যান ছিল না। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। সিঁড়িগুলো ছিল খুব সরু। জানালাগুলো কাঁচ দিয়ে বন্ধ ছিল, ফলে ধোঁয়া বের হতে পারেনি।
কাজী নজমুজ্জামান বলেন, ‘যদি জানালাগুলো খোলা থাকতো, তাহলে ধোঁয়া বের হয়ে আসতো এবং হতাহতের সংখ্যা কমতে পারতো।’
গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘চারতলা থেকে একজনের এবং ছয়তলার ছাদের গেটে তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। মরদেহগুলো কিছুটা আগুনে পোড়া থাকলেও শনাক্ত করা সম্ভব। আমাদের ধারণা, এ চারজন হোটেলের অতিথি ছিলেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঘটনাস্থলে হোটেল বা পার্লারের কাউকে পাওয়া যায়নি। ভবনের নিরাপত্তার চরম অব্যবস্থাপনা ছিল।’
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, মরদেহগুলো পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে এবং ভবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে তদন্ত করা হবে।
এই অগ্নিকাণ্ডে ভবন মালিক ও কর্তৃপক্ষের অবহেলা এবং অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার অভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তদন্ত শেষে এ ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা কাজী নজমুজ্জামান বলেন, ‘মালিক বা কর্তৃপক্ষের কাউকে আমরা পাইনি। তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে, তারপর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।’